লাকসাম মিডিয়া গ্যালারী

#htmlcaption1 লাকসাম মাল্টি-মিডিয়া হাউস লাকসাম মাল্টি-মিডিয়া হাউস লাকসাম মাল্টি-মিডিয়া হাউস lakshamlive Stay Connected lakshamlive Stay Connected lakshamlive Stay Connected lakshamlive Stay Connected lakshamlive Stay Connected lakshamlive Stay Connected lakshamlive Stay Connected lakshamlive Stay Connected lakshamlive Stay Connected lakshamlive Stay Connected lakshamlive Stay Connected lakshamlive Stay Connected lakshamlive Stay Connected lakshamlive Stay Connected lakshamlive Stay Connected lakshamlive Stay Connected lakshamlive Stay Connected lakshamlive Stay Connected

Friday, 19 May 2017

গাজীর পটের চিত্র ও গান

ছবি দেখে দেখে গান বলা। গাজীর গান। এই দেশের শিল্পরীতি— হারিয়ে গেছে। বাংলাদেশের চিত্রকলার উত্সসন্ধানী যেসব ধারা রয়েছে, গাজীর পটের চিত্র এগুলোর মধ্যে স্থানীয়-মৌলিক ও সবচেয়ে দুর্লভ। গাজীর পটের ব্যবহার কেবল বাংলাদেশ ও বাংলাদেশ সন্নিহিত পশ্চিমবঙ্গের কিছু অঞ্চলে রয়েছে; পশ্চিমবঙ্গে বরং পটের অন্য বিষয় যেমন যমপট, চণ্ডীপট, চক্ষুদান পট প্রভৃতি বিষয়গুলো সম্প্রসারিত হয়েছে। এখানে গাজীর পট ধর্মসাধনার শিল্পপ্রকাশ নয়, নিছক শিল্পখেলা বা লোকরঞ্জনও নয়। গাজীর পটকে বলা যায়, বাংলা বিশেষত পূর্ববঙ্গের সামাজিক-সাংস্কৃতিক বিবর্তনের অনিবার্য শিল্পস্বর। বাংলায় মুসলমান আগমনের অভিঘাত হিসেবে পীর-শক্তির প্রতি সাধারণ মানুষের স্তুতি ও সহস্র বছর চর্চিত অঙ্কনরীতির মিশ্রণে গাজীর পটের বিস্তার। সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পাঁচালী-গীতি-পরিবেশনরীতির বঙ্গীয় বৈশিষ্ট্য। অর্থাৎ বাস্তববাদী আলোকচিত্র-চলচ্চিত্র পূর্বযুগের গাজীর পট এই বাংলার চিত্রকলার পূর্বাধিকার; যার সঙ্গে অন্বিত লোক-সামাজিক আচার, রোগ ও ভয় থেকে মুক্তির উপায়, জীবিকা ও শ্রেণীসংকট।

গাজীর পট বাংলা অঞ্চলে বিশ শতকের মধ্যভাগেই বিলুপ্তির মুখে পড়ে। তবুও পূর্ববঙ্গের কয়েকটি জেলার গঞ্জে-হাট-বাজারে গাজীর পটের পরিবেশন চোখে পড়ত গত শতকের নব্বই দশক পর্যন্ত। বছরের বিশেষ সময় হিন্দু-মুসলমান উভয়ের বাড়িতেও যেত ‘পট-গায়ক’ বা ‘পট-নাচুনী’ (আঞ্চলিক পট-নাচাইন্না) ব্যক্তি। বিনিময়ে চাল, খুবই সামান্য টাকা উপার্জিত হতো, ফলে অনেকেই এই পট-গাওয়াকে ভিক্ষাবৃত্তির সমপর্যায়ে বিবেচনা করত। পটের ­গানের মধ্যে গাজীর উপলক্ষে বিপদমুক্তির চরণ থাকায় লোকবিশ্বাস ও লোকচিকিত্সার যোগ রয়েছে। ফলে বিনোদন ও বিপদভঞ্জনের মিশ্রণ রয়েছে এই পট পরিবেশনায়।

গাজীর পট কেন বিশেষ?

স্থানীয় সংস্কৃতি চিত্রকলায় প্রকাশের কারণে কেবল নয়, বাংলাদেশের চিত্রকলার ইতিহাসে গাজীর পট গুরুত্বপূর্ণ বিপন্নতার কারণেও। এই শিল্পরীতিটি এই দেশে বিলুপ্ত বলা যায়। সুকুমার সেন বলেছিলেন, ‘উভয় বঙ্গে কেবল কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশুতোষ মিউজিয়ামে একটি মাত্র গাজীর পট আছে।’ গুরুসদয় দত্ত ১৯৩২ সালে বিচিত্রায় প্রকাশিত এক প্রবন্ধে পূর্ব বাংলার অশিক্ষিত মুসলমান কর্তৃক ব্যবহূত গাজীর পটের কথা উল্লেখ করেন, যা মুন্সীগঞ্জের শম্ভু আচার্য অঙ্কন করে থাকেন। এর পর প্রবাসী পত্রিকায় কবি জসীমউদ্দীন পল্লীশিল্প শিরোনামে প্রবন্ধে গাজীর পটের বিবরণ দেন। ঠাকুর-বাড়ির আঙিনায় গ্রন্থেও তিনি গাজীর পট সংগ্রহ করে কলকাতায় প্রদর্শনের কথা উল্লেখ করেন। পঞ্চাশের দশকে সুকুমার সেনের গ্রন্থটি পাঠ করে প্রখ্যাত লোকসংস্কৃতি গবেষক তোফায়েল আহমেদের প্রতিক্রিয়া ছিল ‘বইটি পড়ার পর থেকে বিষয়টি একটি চ্যালেঞ্জের মতো হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল আমার কাছে। বাংলাদেশের কোথাও কি একটি গাজীর পট পাওয়া যাবে না?।’ ঠিক একই ধরনের অনুভূতির সঞ্চারণে অনুরণিত হয়েছে বর্তমান প্রবন্ধকারেরও। সম্ভাব্য সব স্থানে অন্বেষণের ফল হলো, বাংলাদেশের কোথাও আর গাজীর পটের ব্যবহার নেই; কেবল রিপ্রডাক্টেড কিছু চিত্রকর্ম জাদুঘর, টি-শার্ট, ওয়েবে দেখা যায়, যার সঙ্গে পটচিত্র প্রদর্শন ও লোকনন্দনের কোনো যোগ নেই। বিখ্যাত গাজীর পটের শিল্পী সুধীর আচার্যের পুত্র শম্ভু আচার্য গাজীর পটের পরিমার্জিত শৈলীসম্পন্ন গাজীর পট অঙ্কন করেন, অধ্যাপক নিসার হোসেনের ভাষ্যে তাঁর কর্ম ‘Modernized and reduced’। এ কারণে গায়েন কর্তৃক ব্যবহূত লোকজ রীতি অক্ষুণ্ন রয়েছে এমন গাজীর পট অত্যন্ত বিরল।

শুধু বিরল— এ কারণে নয়। শিল্পরীতির স্বাতন্ত্র্যেও গাজীর পটের চিত্র বিশেষ। ইউরোপীয় চিত্ররীতি, তিব্বতি চিত্ররীতি ও ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের চিত্ররীতি বাংলাদেশের চিত্রকলাকে স্নেহ-পরিপুষ্টি দান করলেও নিজস্ব শিল্পরীতি নির্মাণ করতে গেলে সমগ্র শিল্পজগেক স্থানীয় উেস ফিরে যেতে হবে। বিশেষ করে রঙের ব্যবহার, রঙের উত্স, তুলির ব্যবহার, ফিগার রূপায়ণ কৌশল, পারস্পেকটিভে স্থূলতা, চরিত্রের আনুপাতিক অসামঞ্জস্যতা, বর্ডার-প্যানেল পদ্ধতির ওপর দাঁড়িয়ে আছে পটের চিত্রকৌশল। বাংলাদেশের গাজীর পট সাধারণত চৌকো পট। পশ্চিমবঙ্গের গুরুসদয় মিউজিয়ামে সংরক্ষিত গাজীর পটগুলো বৃহৎ উলম্ব আকৃতির, এগুলো জড়ানো পট। ফলে পূর্ববঙ্গের গ্রামের দ্বারে দ্বারে পটচিত্র নিয়ে উপার্জনের উদ্দেশ্যে গান পরিবেশন করা পট-পরিবেশকদের ব্যবহূত পটগুলো স্বতন্ত্র। এগুলোর প্রত্যক্ষ অর্থনৈতিক উপযোগিতা রয়েছে, গাজীর ওপর অঙ্কিত-রচিত বিধায় সামাজিকভাবে সমীহ ও শ্রদ্ধার চোখে দেখা হয়, যদিও পট-পরিবেশনকে ভিক্ষাবৃত্তি ও লোকচিকিত্সকের সমপর্যায়ে গণ্য করা হয়। ফলে নির্দ্বিধায় বলা যায়, এই পটগুলোয় লোকঘ্রাণ রয়েছে, রয়েছে পূর্ব বাংলার সহস্র বছরের পরম্পরাগত জীবিকার নির্যাস। বাংলাদেশের চিত্রকলা এই শিল্পমাধ্যমকে নন্দনতত্ত্বের ভিত্তি হিসেবে অনুসরণ করতে পারে নিঃসংকোচে।

কীভাবে মিলল গাজীর পটপটের গান

গাজীর পটের লিরিক খুব দুর্লভ। গায়েনেরা বংশপরম্পরা এই গান মুখস্থ করত। ছবি দেখিয়ে যে গাজীর গান— এমন গান আগে কোথাও লিপিবদ্ধ নেই। আমি শৈশবে নব্বই দশকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর বাজারে হাটের দিন গাজীর পটের আসর দেখে ছিলাম। সেই সূত্রে, একটি অনুমান ছিল পূর্ববঙ্গের জেলাগুলোয় এখনো গাজীর পটের গায়েনদের পাওয়া যেতে পারে। বছর পাঁচ চেষ্টা করে মিলল না। কেবল আমার শৈশবস্মৃতি নয়, লোকশিল্প সমীক্ষক ও সংগ্রাহক তোফায়েল আহমেদের স্মৃতিকথা আমার তৃষ্ণা ও বিশ্বাস বাড়িয়ে দেয়। তোফায়েল আহমেদের বিবরণী থেকে জানা যায়, তাকে বেদের বহরের কালা মিয়া সন্ধান দিয়েছিলেন যে, নরসিংদীর বেদে পাড়ার কোনাই মিয়ার কাছে একটা গাজীর পট আছে। এই সন্ধান পেয়ে তিনি নরসিংদীর রূপগঞ্জে পটের খোঁজে যান ২৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯৮৫ তারিখে। সেখানে গণি মাতবরের বাড়িতে গিয়ে কোনাই বেদের খোঁজ করেন। কিন্তু শুনতে পান, কোনাই গাজীর আসা (দণ্ড) নিয়ে রোজগারে বেরিয়ে গিয়েছে। নিরুত্সাহিত হয়ে ফেরার পূর্বে আশার আলো দেখালেন কোনাইয়ের ছোট ছেলে। তোফায়েল আহমেদের বিবরণী গাজীর পটের গুরুত্ব অনুধাবনে সহায়তা করবে :

‘মোহনগঞ্জের পাথরঘাটে কাছে দাঁড়ানো ছিল কোনাই মিয়ার ৭/৮ বছরের ছেলে। সে বলল, আপনারা যা খুঁজছেন, তা আমাদের ঘরে আছে। গনি মিয়ার বাড়ির বাইরের আঙ্গিনায় মাথার উপর নৌকার ছইয়ের ছাউনী দেয়া কোনাই মিয়ার ঘর। বালকটি সে ঘরে গেল পট আনতে। সে কয়েকটি মুহূর্তের উত্তেজনা অনুমেয়। মানচিত্রের মতো জড়ানো পট নিয়ে এল বালকটি। বাংলাদেশে গাজীর পট আবিষ্কৃত হলো।... ছেলেটির হাতে কয়েকটি টাকা গুঁজে পিছনে ফেলে এলাম কোনাই মিয়ার মিয়ার নৌকা ছইয়ের ঘর। যে ঘর ধারণ করে আছে বাংলাদেশের এক অমূল্য ধন।’

আমার জানা ছিল, বাংলাদেশের নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া— এ চারটি জেলায় মেঘনা-তিতাস বিধৌত তীরে নৌকায় বাস করা একটি সম্প্রদায় রয়েছে, বাইরের মানুষের চোখে তারা বেদে, কিন্তু নিজেরা পরিচয় দেন সদাগর নামে। তাদের কেউ কেউ এখনো ‘পট দেখানো’ বা ‘পট নাচানো’ সচল রেখেছেন। কিন্তু মেঘনা-তিতাসের বুকে তো শত শত সদাগর নৌকা, তারা এখনো চান্দ সদাগরের নাম ধরে রেখেছে। পটের গায়েনের দেখা অত সহজ না। হঠাৎ একদিন খবর পেলাম, ভোলাচং গ্রামের মণিরানীর কাছে পট নাচাইন্না এসেছিল। ঠিকানা বলতে জানা গেছে, নৌকায় থাকে সুদিনে (শীতকালে)। গ্রামের নাম ডোবাচাইল। নৌকাবাসী আর গ্রামের নাম— এই সূত্রের ওপর ভরসা করে রওনা হলাম। সময়টা সেপ্টেম্বর-অক্টোবর ২০১৫ সাল। গায়েনের নাম আখতার হুসেন। তিনি আমাকে নৌকায় নিয়ে বসালেন। পট দেখালেন। বিশেষ অনুরোধে গাজীর পটটি তিনি ‘হাতছাড়া’ করতে রাজি হন। সংগ্রহ করলাম অমূল্য গাজীর পট, ‘রিপ্রডাক্টেড’ নয়, ‘মডার্নাইজড’ নয় এই পট, সঙ্গে গানের কথা, আঞ্চলিক ভাষার রসসমৃদ্ধ, ‘আদি ও আসল’ এবং অকৃত্রিম। এই পটটিকে পটের গানের পেশাদার গায়েন কর্তৃক ব্যবহূত শেষ দিকের নমুনা বলা যায়। এই সন্ধান প্রাপ্তির ফলে বলা যায়, বাংলাদেশের চিত্রকলা ও লোকসম্পদের একটি ধারার অন্তত বর্ণনা বা পর্যালোচনার সুযোগ তৈরি হলো। বিপন্ন ঘোষণার অপেক্ষা না করে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া গাজীর পটই বাংলাদেশের চিত্রকলার স্থানীয় প্রধান উত্স।

বাঘের সওয়ার গাজী বিপদে ত্রাতা

বাঘের পিঠে সওয়ার এক ব্যক্তি যে কিনা বিপদে ত্রাতা হিসেবে হাজির হন, এমন এক মুসলমান পীরকে কেন্দ্র করে একটি আখ্যান প্রচলিত রয়েছে বাংলার বিভিন্ন অঞ্চল— সুন্দরবন সন্নিহিত অঞ্চল থেকে পশ্চিমবঙ্গের উত্তরভাগ পর্যন্ত এবং পূর্ববঙ্গের প্রায় সব অঞ্চলে গাজীর বিচরণ রয়েছে। এ দেশে সব লোকমানসে গাজী পীরের প্রভাবই ব্যাপকতর। লোকসমাজে তিনি সর্ববিপদভঞ্জন পীর। গাজীর আইকনোগ্রাফিক সঙ্গী হলুদাভ শরীর কালো ছোপের বা ডোরাকাটা বাঘ। বাঘের সওয়ার গাজী বা বাঘ গাজীর সহায়— গাজীর এমন মূর্তিই সর্বসাধারণ্যের মানসপটে স্থান নিয়ে আছে।

গাজী নামটির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে বাংলায় ইসলামী সংস্কৃতির বিস্তৃতি। মুসলমান সমাজের সাধারণ বিশ্বাসের সঙ্গে গাজীবন্দনা সাংঘর্ষিক। ইসলামে সাধারণত কোনোরূপ চিত্র-প্রতিমূর্তির পূজা বা স্তুতি কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। কেবল নিরাকার ঈশ্বরের প্রতি সমর্পণই ইসলামে সিদ্ধ। কেন বাংলা অঞ্চলে গাজীর উদ্ভব, তার কারণ বেশ চিত্তাকর্ষক ও গবেষণার বিষয়। গবেষকবৃন্দ মনে করেন, বাংলায় মুসলমান আগমনের পরে এই দেশের স্থানীয় সংস্কৃতির প্রভাবে প্রতিরূপ তৈরির প্রবণতা থেকেই গাজীর সৃষ্টি। গবেষক আনিসুজ্জামান মনে করেছেন ‘হিন্দু দেবদেবীদের সংখ্যাধিক্য ও তাদের গুণাবলির পরিচয় মুসলিম-মানসে যে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে, তার ফলে এসব দেবদেবীর মুসলমান প্রতিরূপও গড়ে ওঠে। গাজী পীর এমনি প্রতিক্রিয়ায় সৃষ্ট ও জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।’

পটেপালায়পুঁথিতে গাজী

বাংলায় একক কোনো মাধ্যমে নয়, বরং শিল্পের ততোধিক শাখায় গাজীর উপস্থিতি রয়েছে। কখনো গাজীর গানের মাধ্যমে পালা পরিবেশনায়, কখনো পুঁথিতে নিরেট সন্ধ্যার আসরের সাহিত্য হিসেবে, কখনো পটে চিত্রল হয়ে মানুষের বাড়িতে বাড়িতে গাজীর বিচরণ ছিল। বিভিন্ন মাধ্যমে গাজীর গল্প বদলেছে, বিভিন্ন অঞ্চলে ভেদ তৈরি হয়েছে, তবে বাঘের পিঠে সওয়ার গাজী সংকটে ত্রাতা হিসেবে হাজির, এমন গাজী অবিকৃত ও অভিন্ন সব মাধ্যমের, সব অঞ্চলের। গবেষক আফসার আহমদ গাজীর গানের আলোচনা প্রসঙ্গে গাজীর জীবনকেন্দ্রিক কিংবা প্রসঙ্গভিত্তিক দুই ধরনের কাহিনীর সন্ধান মেলে, একটি হলো, গাজীকালু চম্পাবতী পুঁথির লেখ্যরূপ। অন্যটি মৌখিক রীতির আখ্যান— জামাল-কামাল, আফতাব-মহাতাব, দিদার-বাদশাহ প্রভৃতি পালা।

গাজীকেন্দ্রিক শিল্পচর্চা বাংলায় কেবল পটের চিত্রে বা আসরকেন্দ্রিক গানে নয়, গাজীর উপস্থিতি রয়েছে গাজীর পুঁথিতেও। তাকে কেন্দ্র করে বিস্তৃত আখ্যান রয়েছে বাংলা পুঁথিসাহিত্যে। গাজীকে কেন্দ্র করে যে আখ্যানটি আবর্তিত, তার কোনো কেন্দ্রীয় স্থিতি নেই। অর্থাৎ আখ্যানটি বিভিন্ন অঞ্চলের বিভিন্নভাবে পরিবেশিত-ব্যাখ্যাত-বর্ণিত হয়েছে। এসব আখ্যানের প্রতিটি কাহিনী, চরিত্র, উপকাহিনী, গল্প বর্ণনকৌশল ভিন্ন। বাংলা একাডেমির সংগ্রহশালায় গাজী-কালু-চম্পাবতীর পুঁথি সংরক্ষিত রয়েছে। পুঁথি শিল্পমাধ্যমটি বিলুপ্ত হলেও চকবাজারের ধাঁচে বাংলাবাজারের একটি প্রকাশনা সম্প্রতি ‘আদি ও আসল ছহি বড় গাজী কালু ও চম্পাবতী কন্যার পুঁথি’ শিরোনামে গ্রন্থ প্রকাশ করেছে, যা মূলত আব্দুর রহিম প্রণীত। সুকুমার সেন প্রথম গাজী-বিষয়ক ততোধিক পুঁথি থাকার কথা জানান, তবে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া। তিনি চারজনের চারটি ভিন্ন পুঁথির বর্ণনা দিয়েছেন। পুঁথিগুলোর রচয়িতা হলো খোদা বখ্শ, কবি হালুমী বা হালু মিয়া, কবি আবদুর রহীম, আবদুল গফুর। চারটি পুঁথির পাণ্ডুলিপির বিবরণ, কবি পরিচিতি, আখ্যানের তুলনামূলক আলোচনা আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া করেছেন। এই পুঁথিগুলোই গাজীর আখ্যানের মূল আকর। তাদের কাহিনীর মধ্যে সম্পর্ক-পার্থক্য উভয়ই রয়েছে। বাংলাদেশে গাজীর পটের কাহিনী এই পুঁথিগুলোর বিক্ষিপ্ত অংশ, যা জনশ্রুতির পর্যায়ে পৌঁছে গেছে বলে গায়েন বা কবিয়ালবৃন্দ ঋণস্বীকারের প্রয়োজন মনে করেন না।

চারটি পুঁথির আখ্যানের মধ্যে কেন্দ্রাতিক গতি একই হলেও পার্শ্বচরিত্রের নাম, স্থান নামে পার্থক্য রয়েছে। গাজীর মায়ের নাম কেউ বলেছেন ওসামাসুন্দরী, কেউ অজুপা সুন্দরী, কেউ জুলহাউস, কেউ জুলহাস; স্থানের ক্ষেত্রে কেউ বিরাট নগর, কেউ বৈরাট নগর; বাঘের নাম কেউ বলেছেন খানদৌড়া, কেউ বলেছেন খান্দুরা বাঘ। তবে আবদুর রহীমের যে গাজী কালু চম্পাবতী উপাখ্যান— সেটিই সবচেয়ে প্রচলিত।

গাজীর গল্পের ডালপালা অনেক

গাজীর পিতা ছিলেন বৈরাটনগরের শাসক সেকেন্দার শাহ। এই শাহের প্রথম রানী অজুপা সুন্দরীর গর্ভে গিয়াসউদ্দিন, যিনি জুলহাস নামেও পরিচিত এবং বরখান গাজী জন্মগ্রহণ করে। অজুপা সুন্দরী পালিত পুত্রের নাম ছিল কালু। রাজা ও রানীর বড় ছেলে জুলহাস শিকারে গিয়ে হারিয়ে গেলে এরপর বয়সে যোগ্য গাজীকে রাজকর্মভার গ্রহণ করতে বলা হয়। কিন্তু গাজী সাধারণের মতো ছিলেন না। তিনি এই রাজকার্যভার গ্রহণ করার বদলে ফকির হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করে। পিতার পুনরায় আদেশও গাজী প্রত্যাখ্যান করে। এজন্য তার ওপর অত্যাচার চালানো হয়েছিল, কিন্তু গাজীকে তার ইচ্ছা থেকে টলানো যায়নি। রাজার আদেশে জল্লাদ তাকে হত্যা করার চেষ্টা করে কিন্তু দৈব কারণে গাজীর কোনোরূপ ক্ষতি হয়নি (শ্রুতিমতে, একটি লোমও কাটা যায়নি)। এর পর তাকে জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করা হয়, কিন্তু কিছুই হয় না। এর পর গাজীকে পাথরের সঙ্গে বেঁধে একটি সুচসহ সমুদ্রে ফেলা হলো এবং বলা হয় এত দৈবশক্তি থাকলে সাগর থেকে এই সুচ উদ্ধার করতে হবে। অবশেষে সাগর শুকিয়ে যায় এবং খোয়াজ খিজিরের সহায়তায় সুচ পাওয়া যায় এবং গাজী মহানন্দে রাজপ্রাসাদে ফিরে আসেন। এর পর গাজীর সঙ্গে কালুও রাজসিংহাসন ছেড়ে ফকিরি জীবন বেছে নেয় এবং বনে-জঙ্গলে চলে যায়। তাদের আধ্যাত্মিক ক্ষমতায় জঙ্গলের বাঘ-কুমির সব বশীভূত হয়।

গাজীর আখ্যানের দ্বিতীয় পর্বটি শুরু হয় ছাপাইনগরের মুকুট রাজার (মতান্তরে শ্রীরাম রাজা) কন্যা চম্পাবতীর প্রেমে পড়া নিয়ে। চম্পাবতী সাত ভাইয়ের এক বোন। গাজী চম্পাবতীর রূপে মুগ্ধ হয়ে ভাই কালুর মাধ্যমে রাজার কাছে বিয়ের প্রস্তাব পাঠায়। এই প্রস্তাবে রাজা ক্ষিপ্ত হয়ে কালুকে বন্দি করেন। ফলে গাজী রাজার সঙ্গে যুদ্ধ ঘোষণা করল।

গাজী অসংখ্য বাঘ নিয়ে নদী পার হয়ে মুকুট রায়ের রাজধানী আক্রমণ করে। অন্যপক্ষে মুকুট রায়ের মূল সেনাপতি হলেন মিথের আরেক জনপ্রিয় চরিত্র দক্ষিণ রায়। দক্ষিণ রায় কুমির নিয়ে গাজীর সঙ্গে যুদ্ধে নামেন। সম্মুখ দক্ষিণ রায় তার মুগুর দ্বারা গাজীর হাতের আসা (যে দণ্ডটির মাধ্যমে পটচিত্র টানানো হয়) ভেঙে দিলেন। তবে তিনি গাজীর দৈব শক্তির কাছে দক্ষিণ পরাজিত হন। গাজী দক্ষিণ রায়ের কান কেটে, চুলের ১২ হাত লম্বা টিকি কেটে বেঁধে রাখলেন। এই খবর মুকুট রায় শুনতে পেলে তিনি নিজে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। মুকুট রায়ের মূল কৌশল ছিল হাজার হাজার সেনার সঙ্গে গোলন্দাজ বাহিনী অর্থাৎ তোপ-তীর সজ্জিত বাহিনী। মুকুট রায়ের আরেকটি কৌশল হলো মৃত্যুঞ্জীব কূপ থেকে জল নিয়ে মৃত সৈন্য-হাতি-ঘোড়াদের পুনর্জীবিত করা। গাজী এ খবর শুনতে পান। তিনি এই কূপে গোমাংস নিক্ষেপ করেন এবং বাঘ ও পরীদের সহায়তায় গাজী যুদ্ধে জয়ী হন এবং চম্পাবতীকে অধিকার করেন।

এই আখ্যান শেষে আরেকটি উপাখ্যান রয়েছে যোগীদের ধর্মান্তরকরণ এবং পাতালপুরী থেকে হারানো ভাই জুলহাসকে উদ্ধার করে বৈরাটনগরে ফিরে যাওয়া নিয়ে। পুঁথি অনুযায়ী গাজী-কালুর গল্প এমনই। অঞ্চলভেদে শ্রুতিতে শ্রুতিতে পুঁথির এই গল্পের অল্প-বিস্তর বদল ঘটেছে। কিন্তু গাজীর আধ্যাত্মিক ক্ষমতার বিস্ময় অপরিবর্তিত রয়ে গেছে। শিল্পের অন্যান্য মাধ্যমে এই কাহিনীর প্রক্ষেপ ঘটেছে। বিশেষ করে পটগানে-পটচিত্রে। পটগানের বিভিন্ন বিক্ষিপ্ত চরণে পুঁথির আখ্যানের প্রসঙ্গগুলো ঘুরেফিরে এসেছে। কিন্তু পুঁথির কাহিনীর সঙ্গে তুলনা না করলে পটগানের অতি সংক্ষিপ্ত-ইঙ্গিতবাহী চরণগুলো ব্যাখ্যা করা বেশ কঠিন হতো।

গাজীর পটের বিষয়শৈলী

গাজীর গল্প নিয়ে যে পট, তাই ‘গাজীর পট’ বলে সহজে চিহ্নিত করা যায়। কিন্তু বাংলাদেশে এমন এক ধরনের গাজীর পটের ফরম্যাট পাওয়া যায়, তাতে কেবল গাজীর পট নয়, গাজীকে কেন্দ্র করে গ্রাম্য হাস্য-ক্রীড়া উদ্রেক করে এমন চিত্রও সন্নিবেশিত থাকে। গাজীর পট প্রধানত চৌকো অর্থাৎ, উলম্ব আকৃতির হয়ে থাকে। বাংলাদেশে প্রাপ্ত গাজীর পটের সবগুলোই উলম্ব চৌকোনাকৃতির। তবে ঘরে সংরক্ষণের সময় জড়ানো থাকে। জড়ানো পটের মতো বৃহৎ আকৃতির গাজীর পট রয়েছে পশ্চিমবঙ্গের গুরুসদয় মিউজিয়ামে।

বেহালায় অবস্থিত গুরুসদয় মিউজিয়ামে সংরক্ষিত একটি গাজীর পট (ভুক্তি সংখ্যা: জিএম ১৬৭০) এর দৈর্ঘ্য ৬ ফিট ৮ ইঞ্চি এবং প্রস্থ ১ ফুট ১ ইঞ্চি। চারপাশে প্রান্ত রয়েছে ১.২ ইঞ্চি। এই পটটির গাজীর প্যানেলের দৈর্ঘ্য ৪ ফিট ৪ ইঞ্চি। পটটিতে সবুজ, সাদা, লাল, নীল, গেরুয়া (বাঘের রঙ) ছাড়াও আউটলাইন হিসেবে কাল ব্যবহূত হয়েছে। এই জাদুঘরের (ভুক্তি জিএম ১৮৫৬) পটটিও গাজীকেন্দ্রিক কিন্তু এতে বাঘে সওয়ার গাজীর আখ্যান বর্ণিত হয়নি। ফলে চিত্রের সঙ্গে এই পটটির বাণীর সম্পর্ক এখনো অনাবিষ্কৃত। এই পটের প্যানেল সংখ্যা ছাব্বিশটিরও অধিক। শেষের প্যানেলটির অঙ্কন প্রক্রিয়া অসম্পূর্ণ রয়েছে। প্রথম প্যানেলটি সবচেয়ে বড় এবং এতে গাজীর ছবি অঙ্কিত। এর পর ক্রম অনুযায়ী হাতি, ঘোড়া, দুটি মাছ, দুটি রাজহাঁস, শিমুল গাছ, হরিণ, কুমির, খাটিয়ায় শায়িত ব্যক্তি, কয়েকজন মুসলমানের প্রতিকৃতি রয়েছে। এই পটের গল্প উদ্ধার করা বেশ কঠিন, কারণ গাজীর গানের যে আখ্যান বা গাজীর পুঁথির প্রচলিত যে কাহিনী, তার সঙ্গে মূল চিত্রগুলো সাদৃশ্যপূর্ণ নয়। সম্ভবত নতুন কোনো বিষয় নিয়ে এই গাজীর পট।

নৌকাবাসী সওদাগর নিকট প্রাপ্ত চৌকো পটটি প্যানেলের মাধ্যমে বিভক্ত অর্থাৎ খোপে খোপে চিত্র অঙ্কিত। এই পটে মূলত ২২টি প্যানেল রয়েছে। প্রথম উপরিভাগের প্রতি সারিতে তিনটি করে রয়েছে ১২টি প্যানেল। মাঝখানের প্যানেলটি স্বাভাবিকভাবেই বড়, যেখানে বাঘের সওয়ার গাজী রয়েছে ছাতার নিচে। বাকি নিচের অংশে রয়েছে তিনটি সারিতে নয়টি প্যানেল। মুন্সীগঞ্জের বিখ্যাত পটুয়া চিত্রকর সুধীর আচার্য গাজীর পটের চিত্রের ২৫টি প্যানেলের পরিচয় দিয়েছেন, যা তোফায়েল আহমেদ উল্লেখ করেছেন।

প্রথমেই মকরবাহী গঙ্গা, এর পর ঘোড়া ও সহিস, এর পর পুইক্কার মা-বাবা (মাঝে বড় হুক্কা, যা প্রায় মা-বাবার সমান উচ্চতার), এর পর হরিণ-জবাই, মাঝে একটা চরিত্র সম্ভবত গাজীর আসা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, নাকাড়া বাজানো, এর পর দুটি প্যানেলে সমদৃশ দুটি বাঘ: আন্দুরা ও খান্দুরা বাঘ, দুই বাঘের প্যানেলের মাঝে শাইল-শুয়া দুটি পাখি, এর পর কুমির, সওদাগরের বাণিজ্য যাত্রা, মাঝখানে বড় প্যানেল প্রায় চারভাগের একভাগজুড়ে: বাঘের পিঠে সওয়ার গাজী; নিচের সারির প্রথম প্যানেলে গাইকে বাঘের নেয়ার দৃশ্য, দধিভারসহ গোয়ালা, চরকার সুতা কাটা, বাঁধা বক্ষিলা, ডাল্লা খোঁপার নারী, যম রাজার মা, যমদূত, কালদূত।

নৌকাবাসী গায়েন ও সওদাগর আখতার মিয়ার পটটিতে রঙ ব্যবহূত হয়েছে লাল, হলুদ, নীল, সাদা, কালো ও সবুজ (সায়ান)। মোট ছয়টি রঙ। পটচিত্র-পটগানের পরিবেশন রীতি বেশ সরল, যদি তা চৌকোপট হয়। একজন পট-নাচুনে একটা দণ্ডের মধ্যে গাজীর পটটি ঝুলিয়ে দেয়, এই ঝোলানো পটে ছোট লাঠি দিয়ে হালকা আঘাত বা টোকা দিয়ে গান পরিবেশন করতে থাকে। দর্শকরা অর্ধগোলাকৃতি বা গোলাকার হয়ে দাঁড়িয়ে পটের গান উপভোগ করেন।

গাজীর পট কেবল চিত্র হিসেবে ব্যবহার্য নয়। অর্থাৎ দেয়ালে টাঙিয়ে রাখার জন্য নয়, এর উত্কৃষ্ট প্রয়োগ ঘটে যখন পটটি সামনে রেখে কাহিনী গানে বর্ণিত হয় অর্থাৎ চিত্রভাষ্যের সম্মিলনই গাজীর পটের শিল্পিত মুক্তি। পটের চিত্রের মতোই ভাষ্যও আকর্ষণীয়। এই ভাষ্যে গাজীকেন্দ্রিক কয়েকটি ক্ষুদ্র আখ্যান এবং সঙ্গে বিক্ষিপ্ত গ্রামীণ রসাত্মক ঘটনাবলি স্থান পেয়েছে। একটি চিত্রে ধারণ সম্ভব এমন ঘটনাই গাজীর পটের প্যানেলগুলোয় চিত্রিত হয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দোঁহা অর্থাৎ কাপলেট আকারে চিত্রের বর্ণনা করা হয়েছে। আখতার মিয়ার কণ্ঠে পরিবেশিত গানটি অত্যন্ত দুর্লভ। বাংলাদেশে ও পশ্চিম বাংলায় গাজীর পট পূর্ণাঙ্গরূপে পরিবেশনকারীর সংখ্যা একেবারে নেই, যারা দাবি করেছেন খণ্ডিত, বিক্ষিপ্ত অবস্থায় আংশিক পরিবেশন করতে পেরেছেন; বাকিরা বিস্মৃত। এই গানে গ্রামবাংলার আবহমান কালের ঐতিহ্য, সাংস্কৃতিক উত্কর্ষ, লোকমানসে সুপ্ত বিশ্বাস প্রকাশিত হয়েছে। গানটিকে দুটি প্রধান অংশে ভাগ করা যায়। প্রথম অংশে গাজীর মাহাত্ম্য বর্ণিত হয়েছে, এই অংশটি মঙ্গলকাব্যের মূলভাবের অনুরূপ, সংকটে ফেলে গাজীর অলৌকিক ক্ষমতা প্রকাশ করাই এই কাহিনীর গন্তব্য: ‘আগেত জানিনা আল্লা গাজী ইমুন পির/ আগে দিতাম দুধঅ কলা পাছে দিতাম ক্ষির’। গাজীর পরিচয় ও লোকমানসে গাজীকে প্রতিষ্ঠা প্রথম অংশের উদ্দেশ্য। দ্বিতীয় অংশটি মূলত লোকরঞ্জন ও বিনোদনের জন্য। এই অংশ আসর জমানোর জন্য হাস্যরসমিশ্রিত। কিন্তু এই অংশটিকে খুব সরল ও নিরীহভাবে পাঠ করাই যথেষ্ট নয়; এই অংশে অবজ্ঞাত নিরক্ষর সামষ্টিক সমাজের অন্তর্নিহিত সত্যগুলো গোপন রয়েছে, যা কার্ল গুস্তাভ ইয়ুং কথিত যৌথ অবচেতনাকে (Collective Unconscios) সংহতরূপে প্রকাশ করে।

নারীদের সংকীর্ণ চোখ থেকে অর্থাৎ বৃহত্তর সমাজ যেভাবে দেখতে চায়, সেভাবে প্রকাশিত হয়েছে। তাই নতুন কাপড় পরিধান করে অভিসারে গমন বা পাড়া বেড়ানোকে নিরুত্সাহিত করা হয়েছে, বড় খোঁপা বাঁধা নিয়ে ব্যঙ্গ করা হয়েছে; নারীকে সতর্ক করা হয়েছে যেন স্বামী বা ভাই উভয়ের কাছ থেকে লুকিয়ে পিঠা না খেয়ে ফেলে, এর পরিণাম স্বামীর প্রহার, সেই সঙ্গে চূড়ান্ত সতর্কতা: ‘বোন বাতাসি... পয়লা জামাইর ভাত না খেলে লাগে অলক্ষ্মী’। নারীর প্রতি এমন দৃষ্টির কারণ হলো, গৃহে অন্তরীণ নারীরাই এই গাজীর পটের প্রধান দর্শক। হাটে-গঞ্জে পুরুষরাও এর ভোক্তা, তবে সর্বতোভাবে অবগুণ্ঠনে উত্সাহী পুরুষতান্ত্রিক সমাজের প্রতিফলনই এই গান।

পটের গানে রোগমুক্তি, বিপদমুক্তির কথা যেমন রয়েছে, তেমনি গাজী-গাজীর পট-পরিবেশনকারীকে অবহেলাকারীর শাস্তিও গানে বর্ণিত রয়েছে। যারা কৃপণ অর্থাৎ বক্ষিল সম্প্রদায়, তাদের করুণ মৃত্যুর কথাও স্মরণ করে দেয়া আছে গানে। এর কারণ পটের গান পরিবেশনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে অর্থপ্রাপ্তি; উপস্থিত শ্রোতা-দর্শক সবাই যাতে অর্থদানে উত্সাহিত হন, সে কারণে এই চরণগুলো বিন্যস্ত রয়েছে। ফলে বলা যায়, লোকহাস্যরসের এই উপাদানগুলো সামাজিক মনস্তাত্ত্বিক ব্যাকরণের কোনো না কোনো অনুষঙ্গকে প্রকাশ করছে। লোকনন্দনের অনাবিষ্কৃত পরিচয় পেতেও এই গান বিশ্লেষণ-উপভোগ জরুরি।

বিদায় গাজীবাই বাই ‘পট-নাচাইন্না

পটচিত্র পাওয়ার ফলে হয়তো একাডেমিক উপকার হয়েছে! কিন্তু একই সঙ্গে এই বার্তা জানানো প্রয়োজন, নৌকাবাসী সওদাগরের অন্য পেশায় চলে যাচ্ছে। এই শিল্পীদের মানসিক জটিলতা রয়েছে নিজেদের সুকুমার বৃত্তি নিয়ে। আমরা যাকে লোকনন্দন বলে অভিহিত করছি, সাধারণ্যের কাছে তা ভিক্ষাবৃত্তির সমতুল্য। ফলে ক্রমেই নিজেদের গুটিয়ে আনার আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করেন তারা। অন্য উপার্জন অধিকতর সম্মানের, ফলে লোকরঞ্জনের মাধ্যমে উপার্জনকে আর সম্মানের মনে করছে না তার সমাজ। যে সমাজ এরই মধ্যে প্রান্তিকায়িত, তাকে প্রবল-বৃহেগাষ্ঠী আরো বিলুপ্তি-বিচ্ছিন্নতার দিকে ধাবিত করে দিচ্ছে; প্রান্তিক গোষ্ঠীর শিল্পসম্পদকে প্রতিপালিত-পৃষ্ঠপোষণ করার বদলে।

সর্ববিপদভঞ্জন পীর বাঙালির মানসপট থেকে বিদায় নিয়েছে বহু আগে। গাজীর পটচিত্রের ওপর আর কখনই হয়তো গায়েনের বেতের স্পর্শ পড়বে না এই বাংলায়। গাজীর পটের বানীর ডকুমেন্টশন ও গাজীর পটের চিত্র ডিজিটাল মাধ্যমে সংরক্ষণের মাধ্যমে বাংলার শিকড়সন্ধানী এই শিল্প-প্রকরণটিকে অন্তত ঐতিহ্যিক উপকরণ হিসেবে জাদুঘরে কিংবা আর্ট-হিস্ট্রির অভিজাত আলোচনায় স্থান দেয়া যাবে। কিন্তু যারা এই শিল্পটিকে জীবনঘনিষ্ঠ করে চর্চা করতেন, তাদের পেশা-সংস্কৃতি চিরতরে বদলে যাচ্ছে। গাজীর পট নিয়ে ভাসমান জললগ্ন অক্ষরজ্ঞানহীন জনগোষ্ঠী উত্খাত হচ্ছে ডাঙায় আদি কৌম ছেড়ে, আর দশটি আধুনিক পেশায় নিজেদের অভিযোজনের মাধ্যমে

0 comments:

Post a Comment